থাইরয়েড ক্যান্সার
শরীরে অস্বাভাবিক কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যাওয়াই হলো ক্যান্সার। দেহের সাধারণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। এই অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া কোষগুলি লিম্ফ বা লসিকা এবং রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে আশেপাশের সুস্থ কোষ গুলিতেও প্রভাব বিস্তার করে এবং এইভাবে ক্যান্সার ধীরে ধীরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
থাইরয়েড গ্রন্থিতে ক্যান্সার দেখা দিলে তাকে থাইরয়েড ক্যান্সার বলা হয়। এই থাইরয়েড গ্রন্থি হল গলার নীচের দিকে অবস্থিত একটি প্রজাপতি আকারের গ্রন্থি। এই গ্রন্থির কাজ হল শরীরের বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা। এছাড়াও থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন আমাদের দেহের হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ, দেহের স্বাভাবিক উত্তাপ এবং ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
থাইরয়েড ক্যান্সারের কারণ ও ঝুঁকির অন্যান্য সম্ভাবনা
- ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের থাইরয়েড ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা বেশী।
- উচ্চ মাত্রার বিকিরণের সংস্পর্শে আসা
- কিছু জিনগত অসুখ যেমন মাল্টিপল এন্ডোক্রিন নিওপ্লাসিয়া
- শরীরে আয়োডিনের ঘাটতি
থাইরয়েড ক্যান্সারের প্রকারভেদ
- প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সার: এই ক্যান্সার ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় , কিন্তু অচিরেই গলার লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্রন্থিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে
- ফলিকিউলার থাইরয়েড ক্যান্সার: এই ক্যান্সার লিম্ফ নোড এবং রক্ত জালিকাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- মেডুলারি ক্যান্সার: এই ক্যান্সার সাধারণত প্রাথমিক স্তরেই ধরা পড়ে
- অ্যানাপ্লাস্টিক ক্যান্সার: এই ক্যানসার সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়। এবং এর চিকিৎসা করাও সবচেয়ে কঠিন।
থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণ ও উপসর্গ
- গলায় ও ঘাড়ে ব্যথা
- গলায় ফোলা ভাব বা মাংসপিন্ড সৃষ্টি হওয়া
- ঢোক গিলতে কষ্ট হওয়া
- গলার স্বর কর্কশ হয়ে যাওয়া
- কাশি
থাইরয়েড ক্যান্সারের বিভিন্ন স্তর
- স্টেজ ১: এই অবস্থায় টিউমার ছোট আকারের থাকে। সর্বাধিক ২ সেন্টিমিটার পর্য্যন্ত এর আকার হয় এবং এটি থাইরয়েড গ্রন্থির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
- স্টেজ ২: এই স্তরে টিউমারের আকার বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তা ৪ সেন্টিমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এই অবস্থাতেও টিউমারটি শুধুমাত্র থাইরয়েড গ্রন্থিতে থাকে।
- স্টেজ ৩: এই অবস্থায় টিউমার আকারে ৪ সেন্টিমিটারের থেকে বড় হয়, কিন্তু থাইরয়েড গ্রন্থিতে সীমাবদ্ধ থাকে।
- স্টেজ ৪: এই অবস্থায় টিউমার সর্বোচ্চ আকার ধারন করে এবং নিকটবর্তী সফ্ট টিস্যু, স্বরযন্ত্র, শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এমনকি রেকারেন্ট ল্যারিনজিয়াল নার্ভ (স্বরযন্ত্রে অবস্থিত স্নায়ু) পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়।
থাইরয়েড ক্যান্সার নিরূপণ
- থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা দেখার জন্য শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা
- রক্ত পরীক্ষা
- সন্দেহজনক থাইরয়েড টিস্যুর নমুনা সংগ্ৰহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা
- সিটি স্ক্যান
- পি ই টি- সিটি স্ক্যান
- যেসব রোগীর ক্ষেত্রে মেডুলারি থাইরয়েড ক্যান্সার সন্দেহ করা হয়, তাদের জিন পরীক্ষা করে দেখা হয়, কারণ যদি কারো মেডুলারি থাইরয়েড ক্যান্সার হয়, তবে জিনের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে।
থাইরয়েড ক্যানসারের চিকিৎসা
সার্জারি
- থাইরয়েডক্টমি: থাইরয়েডক্টমি অপারেশনের দ্বারা থাইরয়েড গ্রন্থিটি সম্পূর্ণ বা আংশিক কেটে বাদ দেওয়া হয়
- থাইরয়েড লোবোক্টমি: ক্যান্সার যদি প্রাথমিক অবস্থায় এবং থাইরয়েড গ্রন্থির অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে, তাহলে থাইরয়েড লোবোক্টমি নামক অপারেশন করা হয়। এই অপারেশনে কেবলমাত্র অর্ধেক থাইরয়েড গ্রন্থিই বাদ দেওয়া হয়।
- লিম্ফ নোড ডিসেকশন: সাধারণত লিম্ফ নোড বা লসিকাগ্রন্থির মাধ্যমেই ক্যান্সার এক স্থান থেকে আরেক স্থানে ছড়ায়। এই কারণে, যদি আপনার চিকিৎসক যদি মনে করেন যে ক্যান্সার লিম্ফ নোডে ছড়িয়েছে, তবে তিনি লিম্ফ নোড অপারেশন করে বাদ দেবার পরামর্শ দিতে পারেন, যাতে ক্যান্সার আর ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
থাইরয়েড হরমোন থেরাপি
রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি হল মূলতঃ একটি ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ বা চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা শরীরের অভ্যন্তরে অতি দ্রুতহারে বাড়তে থাকা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলির বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করে এবং তাদের নির্মূল করে। এই ওষুধ সাধারণতঃ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
যদিও কেমোথেরাপির বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা সত্ত্বেও এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিয়েশন বা ক্যান্সারের অপারেশনের চাইতে আলাদা। কারণ, রেডিয়েশন থেরাপি বা অপারেশন ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্য করে চিকিৎসা করে। অন্যদিকে, কেমোথেরাপির ওষুধ মেটাস্টেসিস পর্যায়ে থাকা অর্থাৎ দেহের অন্যান্য অংশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার সেলগুলিকেও ধংস করতে সক্ষম। (আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন: কেমোথেরাপি)
রেডিয়েশন থেরাপি
সুনির্দিষ্ট ঔষধ প্রয়োগ বা টার্গেটেড ড্রাগ থেরাপি
ইমিউনোথেরাপি
প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা সেবামূলক চিকিৎসা
প্যালিয়েটিভ কেয়ার হল এক ধরনের বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধম্যে ক্যান্সার জাতীয় গুরুতর রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগ সম্পর্কিত যন্ত্রণা ও অন্যান্য উপসর্গ কমানোর চেষ্টা করা হয়। এই প্যালিয়েটিভ কেয়ার অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন কেমোথেরাপি বা রেডিয়েশন থেরাপির সাথেই প্রয়োগ করা যায়। এই চিকিৎসা প্রণালীর মাধ্যমে রোগীর যন্ত্রণার উপশম করা হয় এবং তাঁরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সক্ষম হন।