টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট
হিপ রিপ্লেসমেন্ট হলো এমন একটি চিকিৎসা পদ্ধতি যার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাত প্রাপ্ত হিপ জয়েন্ট অর্থাৎ কোমরের নীচের অংশের হাড় (নিতম্বের হাড়) সার্জারির সাহায্যে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই সার্জারি বা অপারেশনের মাধ্যমে সার্জেন হিপ জয়েন্টটি বাদ দিয়ে কৃত্রিম হিপ জয়েন্ট বসিয়ে দেন। এই কৃত্রিম হিপ জয়েন্ট সাধারণত উচ্চ মানের দামী ধাতু বা প্লাস্টিকের তৈরী হয়।
সম্পূর্ণ হিপ রিপ্লেসমেন্ট তখনই করা হয় যখন অন্যান্য সমস্ত রকম চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো কাজ হয়না এবং রোগীর অবস্থার কোনো রকম উন্নতি দেখা যায় না। এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য হল ক্ষতিগ্রস্ত হিপ জয়েন্টটি অপসারণ করা, যাতে রোগীর শারীরিক অস্বস্তি, যন্ত্রনা এবং নড়াচড়ার অসুবিধা দূর করা যায়। তার সাথে সাথে, এই চিকিৎসা রোগীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গের স্বাভাবিক নড়াচড়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে রোগীকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সাহায্য করে।
হিপ জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণ
হিপ জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবার প্রধান কারণ হল অস্টিওআর্থ্রাইটিস। এই রোগে শরীরের তরুণাস্থি ক্ষয়ে যায়, যার ফলে হাড় ও হাড়ের সন্ধিগুলির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। অস্টিওআর্থ্রাইটিস ছাড়াও অন্যান্য যেসব কারণে হিপ রিপ্লেসমেন্টের প্রয়োজন হতে পারে, সেগুলি হলো:
- রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা গেঁটে বাত
- পোস্ট ট্র্ম্যাটিক আর্থ্রাইটিস বা আঘাত পাবার ফলে সৃষ্ট বাত
- অস্টিওনেক্রোসিস
- হাড় ভেঙে যাওয়া বা সরে যাওয়া
- ছোটোবেলায় কোনো আঘাত বা চোট পাওয়া
হিপ রিপ্লেসমেন্ট কখন করতে হয়?
শুধুমাত্র ব্যথা বা হাড়ের শক্তভাব থাকলেই চিকিৎসকেরা টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট অপারেশনের সুপারিশ করেন না। সাধারণত রোগীর শারীরিক অবস্থা ও উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যার দ্বারা উপসর্গগুলির অন্তর্নিহিত কারণ সঠিকভাবে জানা যায়। এই উপসর্গগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ব্যথার ওষুধ খাওয়ার পরও অসহ্য যন্ত্রনা হওয়া
- তরুণাস্থি ক্ষয়ের ফলে কোমরে এবং হিপ জয়েন্টে ব্যথা হওয়া এবং প্রদাহ
- হাঁটা চলায় অসুবিধা
- অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সাধারণ নড়াচড়ায় অসুবিধা
- ব্যথা ও অস্বস্তির কারণে ঘুম।না হওয়া
- হিপ জয়েন্ট ও কোমরের হাড় শক্ত হয়ে আটকে যাওয়া
হিপ রিপ্লেসমেন্টের বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা
হিপ জয়েন্টের ব্যথা ও অন্যান্য অসুবিধা দেখা দিলে সব ক্ষেত্রে হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি না করলেও চলে। এর বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম প্রণালী বার্মিংহ্যাম হিপ রিসারফেসিং সার্জারি নামে পরিচিত। যদিও এই চিকিৎসা প্রণালী সাধারণত কম বয়সীদের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়। নবজাতক থেকে শুরু করে ৪০-৫০ বছর বয়সী ব্যক্তিদের জন্য এই চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এই সার্জারিতে সম্পূর্ন হিপ জয়েন্টটি প্রতিস্থাপন করার পরিবর্তে চিকিৎসক হাড়ের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটিকে চেঁছে তুলে দেন এবং ঐ জয়েন্ট বা হাড়ের সন্ধির অংশটিকে সাপোর্ট বা অবলম্বন দেওয়ার জন্য একটি কৃত্রিম ব্রেস বা বন্ধনী লাগিয়ে দেন। এর ফলে হাড়ের নমনীয়তা বৃদ্ধি পায় এবং রোগী পুনরায় স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে সক্ষম হয়। এর সাথে সাথে, ব্যথাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। চিকিরসকেরা সাধারণত টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্টের পরিবর্তে এই চিকিৎসারই সুপারিশ করে থাকেন, যদিও এর সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সর্বদা অস্থি বিশেষজ্ঞ বা অর্থোপেডিক সার্জেন নিয়ে থাকেন। এবং এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তিনি রোগীর বয়স, দেহের ওজন, হাড়ের ক্ষতির পরিমাণ, দেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ইত্যাদি সব রকম বিষয় খতিয়ে দেখেন।
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট এবং হিপ রিসারফেসিং—এই দুই প্রধান সার্জিক্যাল চিকিৎসা ছাড়াও হিপ জয়েন্টের চিকিৎসার জন্য নানা ধরণের চিকিৎসা প্রণালী উপলব্ধ। এর মধ্যে অপারেশন ছাড়া যেসব চিকিৎসা ব্যবস্থার সাহায্য নেওয়া যায়, তার মধ্যে উল্লেখ্য হলো:
- ব্যথার ওষুধ
- ফিজিওথেরাপি
- জয়েন্ট সাপ্লিমেন্ট
- ওজন কমানো
- দৈনন্দিন অভ্যাস ও জীবনচর্যায় পরিবর্তন
হিপ রিপ্লেসমেন্ট অপারেশনের প্রয়োজনীয়রা নির্ধারণের জন্য ডায়াগনষ্টিক পরীক্ষা নিরীক্ষা
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি প্রণালীর ব্যাখ্যা
অপারেশনের প্রস্তুতি
রক্ত দান
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি মূলতঃ দুটি পদ্ধতিতে করা যেতে পারে:
- প্রথাগত ওপেন সার্জারি
- মিনিমালি ইনভেসিভ অর্থাৎ ন্যূনতম কাটাছেঁড়া করে সার্জারি
যদিও এই দুই পদ্ধতিতেই অপারেশনের প্রণালী মূলত একইরকম থাকে, এদের মূল পার্থক্য হল অপারেশনের জন্য শরীরে কাটার পরিমাণ। প্রথাগত ওপেন সার্জারির জন্য অনেকখানি অংশ কেটে অপারেশন করতে হ্য়। অন্যদিকে মিনিমালি ইনভেসিভ সার্জারিতে নেহাৎই অল্প পরিমাণ অংশ কাটতে হয়। এছাড়াও, এই দ্বিতীয় পদ্ধতিতে অপারেশনের পরের যন্ত্রনা অনেক কম হয় এবং সেলাই শুকোতে ও সম্পূর্ণ নিরাময় হতে প্রথাগত ওপেন সার্জারির চাইতে তুলনামূলক ভাবে কম সময় লাগে।
এই টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারি করার জন্য রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ করে সম্পুর্ন অচেতন করে নেয়া হয়।
অপারেশনের বিভিন্ন ধাপ
- প্রথম ধাপ: প্রথমে সার্জেন হিপ বা নিতম্বের কাছে জায়গাটি প্রয়োজন মত কেটে নেন এবং ঐ কাটা অংশ দিয়ে নিতম্বের পেশীগুলি সরিয়ে জায়গাটি খালি করে নেন। এর ফলে হিপ জয়েন্ট বা হাড়ের জোড়া অংশটি পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। এরপর হাড়ের যে বলের মত অংশটি ফিমার নামক পায়ের হাড়ের সাথে যুক্ত থাকে, সেই অংশটি চেঁছে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ওই অংশে কৃত্রিম হাড় বা জয়েন্ট স্থাপন করা হয়। স্থাপন করার সময় কৃত্রিম হাড়টি ফিমার হাড়ের সাথে এমন ভাবে যুক্ত করা হয় যাতে তার বলের মত অংশটি জয়েন্টের বাইরে বেরিয়ে থাকে।
- দ্বিতীয় ধাপ: পরবর্তী ধাপে চিকিৎসক হিপ বোনের সকেট অংশটি প্রস্তুত করেন এবং যদি অন্যান্য কোনো হাড় বা তরুণাস্থিতে কোনোরকম ক্ষয় থাকে, তাও বাদ দিয়ে দেন। এরপর কৃত্রিম জয়েন্টের কাপের মত অংশটি সকেটে বসিয়ে ফিমার হাড়ের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এছাড়াও অপারেশনের পর যাতে দেহের ওই অংশে অতিরিক্ত তরল জমা না হয়, তার জন্য একটি অতিরিক্ত ড্রেন বা তরল নিঃসরণের পথ তৈরী করে দেবার প্রয়োজন হতে পারে।
কৃত্রিম জয়েন্টটি স্থাপন করা হয়ে গেলে চিকিৎসক আর কোনো হাড়ে বা তরুণাস্থিতে কোনো ক্ষয় অথবা আঘাত আছে কিনা তা ভালোভাবে পরীক্ষা করে নেন। যদি সেরকম কোনো আঘাত বা ক্ষয় থাকে, তাহলে সেই হাড়ও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ওই অংশের পেশীগুলি যথাস্থানে স্থাপন করে কাটা অংশটি সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রক্ত দান
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির ঝুঁকি
এই অপারেশনে সাধারণত যেসব ঝুঁকি বা জটিলতার সম্ভাবনা থাকে, সেগুলি হলো:
- সংক্রমণ
- কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দেহের প্রতিক্রিয়া
- অপারেশনের সময় হাড় ভেঙে যাওয়া
- রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া বা অন্যান্য রক্তপাতের সমস্যা
- কৃত্রিম জয়েন্ট নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সরে যাওয়া না আলগা হয়ে যাওয়া
- মেটাল অন মেটাল সংক্রান্ত জটিলতা
হিপ রিপ্লেসপমেন্ট অপারেশনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল পায়ের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যাওয়া, কেননা কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ফলে অনেক সময়ই পায়ের দৈর্ঘ্যের হেরফের হয়ে যায়।
অপারেশনের পরবর্তী সেবা যত্ন এবং সাবধানতা
টোটাল হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির পর আপনি হাসপাতাল থেকে যেসব সেবা শুশ্রূষা পাবেন:
- অপারেশনের পরের দিন থেকেও ফিজিক্যাল থেরাপি শুরু করা হবে
- রোগীকে স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করার জন্য ক্রাচ বা ওয়াকার দেওয়া হবে
- অপারেশনের পর কয়েকদিন রোগীকে দুই পায়ের মাঝখানে বালিশ বা কুশন নিয়ে থাকতে হবে, যাতে কৃত্রিম অঙ্গ ঠিকঠাক ভাবে জায়গায় বসে যায়
- অপারেশনের সেলাইয়ের ক্ষত স্থান আপনার পরবর্তী চেক আপের সময় ভালোভাবে পরিষ্কার করে ড্রেসিং করে দেওয়া হবে। এটি সাধারণত অপারেশনের ২ সপ্তাহ পর করা হয়। মনে রাখবেন, সেলাইয়ের ক্ষতস্থান না শুকোনো পর্যন্ত খুব সাবধানে এবং পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। এর জন্য আপনাকে প্রতিদিন নিয়মিত ভাবে এবং যথাযথ নিয়ম মেনে ড্রেসিং করতে হবে।চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ক্ষতস্থান না শুকোনো অব্দি সেখানে কোনো রকম ক্রীম, মলম, লোশন বা জল লাগাবেন না। অপারেশনের ৩ থেকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রোগী নিজের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অপারেশনের পর ১ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত কোনো রকম ভারী কাজ বা হিপ জয়েন্ট ঘুরিয়ে করতে হয় এমন কোনো কাজ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ফিজিওথেরাপি চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।