নন-হজকিন্স লিম্ফোমা

এই পোস্টে পড়ুন: English العربية 'তে

নন-হজকিন্স লিম্ফোমা

নন-হজকিন্স লিম্ফোমা একধরণের ক্যান্সার। দেহের লসিকাতন্ত্র বা লিম্ফ‍্যাটিক সিস্টেমে এই রোগ বাসা বাঁধে। লসিকাতন্ত্র বা লিম্ফ‍্যাটিক সিস্টেম হল শরীরের রোগ প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ন অংশ। এই তন্ত্র সারাদেহে ছড়িয়ে থাকে এবং শরীরকে রোগজীবাণুর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। নন-হজকিন্স লিম্ফোমা রোগে শরীরে অবস্থিত লিম্ফোসাইট নামক একধরণের শ্বেত রক্তকণিকাতে টিউমারের সৃষ্টি হয়।

এই রোগ সাধারণ লিম্ফমারই একটি প্রকারভেদ, এবং হজকিন্স লিম্ফোমার চাইতে অধিক পরিমাণে দেখা যায়। রিড-স্টারনবার্গ নামক একধরণের অস্বাভাবিক কোষের উপস্থিতির মাধ্যমে নন-হজকিন্স লিম্ফোমাকে হজকিন্স লিম্ফোমার থেকে আলাদা করা যায়। এই কোষগুলি শুধুমাত্র হজকিন্স লিম্ফোমার ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র দেখা যায়, কিন্তু নন-হজকিন্স লিম্ফোমার ক্ষেত্রে এর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। নন-হজকিন্স লিম্ফোমার চিকিৎসা পদ্ধতিও হজকিন্স লিম্ফোমার চাইতে পৃথক হয়।

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার প্রকারভেদ

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার নানারকম প্রকারভেদ দেখা যায়। এইগুলি হল:

  • বি-সেল লিম্ফোমা– চিকিৎসকদের বক্তব্য অনুযায়ী নন-হজকিন্স লিম্ফোমার ৮৫% ঘটনাই বি-সেল লিম্ফোমা। বিক্ষিপ্ত, বৃহদাকার (ডিফিউজ, লার্জ) বি-সেল লিম্ফোমা হল এই প্রকার লিম্ফমার সর্বাধিক পরিচিত রূপ। এছাড়াও, বার্কিট লিম্ফোমা, লিম্ফোপ্লাজমাসাইটিক ম্যান্টল সেল লিম্ফোমা, মার্জিনাল জোন বি-সেল লিম্ফোমা, এক্সট্রানোডাল মার্জিনাল জোন বি-সেল লিম্ফোমা, সমল লিম্ফোসাইটিক লিম্ফোমা, মিডিয়াস্টিনাল লার্জ বি-সেল লিম্ফোমা ইত্যাদি হল বি-সেল লিম্ফোমার অন্যান্য প্রচলিত রূপ।

 

  • টি-সেল লিম্ফোমা- এই প্রকার লিম্ফোমা প্রায় ১৫% ক্ষেত্রে দেখা যায়। দুইধরণের কোষ প্রধানতঃ টি-সেল তৈরী করে। এগুলি হল প্রান্তস্থ বা পেরিফেরাল টি-সেল লিম্ফোমা এবং কিউটেনিয়াস টি-সেল লিম্ফোমা।

 

  • ফলিকিউলার লিম্ফোমা- এটি একটি অত্যন্ত বিরল প্রজাতির বি-সেল লিম্ফোমা।

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার কারণ

যদিও অনেক চিকিৎসকের মতেই নন-হজকিন্স লিম্ফোমার সঠিক কারণ এখনো অজ্ঞাত, কিন্তু কিছু গবেষণা অনুযায়ী শরীরের দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাই এই রোগের জন্য দায়ী। মানবশরীরে প্রায়শঃই বিভিন্ন অস্বাভাবিক লিম্ফোসাইট (এক ধরনের শ্বেত রক্তকণিকা) তৈরী হয়, যা থেকে ক্যান্সারের সৃষ্টি হতে পারে। এই অস্বাভাবিক লিম্ফোসাইটগুলি নন-হজকিন্স লিম্ফোমা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে অন্যান্য কোষের মত সাধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়না। ফলতঃ, স্বাভাবিকভাবে ধ্বংস হবার পরিবর্তে দ্রুতহারে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নন-হজকিন্স লিম্ফোমায় পরিণত হয়। এই অস্বাভাবিক লিম্ফোসাইট কোষগুলি শরীরের লসিকাগ্রন্থিতে জমতে থাকে, এবং তার ফলে এই গ্রন্থিগুলি ক্রমশঃ ফুলে ওঠে।

 

  • বি-সেল: নন-হজকিন্স লিম্ফোমা বি-সেল থেকে শুরু হতে পারে। এই বি-সেল শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরী করতে সাহায্য করে, যা শরীরকে রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই বি-সেলগুলি সর্বপ্রথম ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।

 

  • টি-সেল: টি-সেলও শরীরে প্রবেশ করা বাহ্যিক আক্রমণকে প্রতিহত করে তাদের ধ্বংস করতে সাহায্য করে। যদিও টি-সেলে নন-হজকিন্স লিম্ফোমা সৃষ্টি হবার পরিমাণ বি-সেলের চাইতে অনেক কম।

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার উপসর্গ

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার সাথে সম্পর্কিত উপসর্গ বা লক্ষণগুলি হল নিম্নরূপ:

  • দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি
  • অজ্ঞাত কারণে ওজন হ্রাস পাওয়া
  • ঘাড়, বগল ও কুঁচকির লসিকাগ্রন্থিগুলি ফুলে ওঠা
  • জ্বর
  • বুকে ব্যথা
  • রাত্রে ঘাম হওয়া
  • পেটে ব্যথা
  • শ্বাসকষ্ট ও কাশি
  • পেট ফুলে ওঠা

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার রোগনির্ণয়

যদিও রোগীর শরীরে অস্বাভাবিক লিম্ফোসাইট কোষের উপস্থিতি সাধারণতঃ নন-হজকিন্স লিম্ফোমা নির্দেশ করে, তাসত্ত্বেও চিকিৎসক সঠিক রোগনির্ণয় বা ডায়াগনসিস করার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই কাজের জন্য রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস, পূর্বতন অসুখ, এমনকি তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হয়। এরপর চিকিৎসক সঠিকভাবে নন-হজকিন্স লিম্ফোমা নির্ণয়ের জন্য কিছু নির্দিষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দেবেন।

 

  • শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা : ঘাড়, বগল বা কুঁচকির লসিকাগ্রন্থি গুলিতে কোনো ফোলা ভাব আছে কিনা, চিকিৎসক অবশ্যই তা পরীক্ষা করবেন। এছাড়াও প্লীহা বা যকৃতে কোনো ফোলা ভাব আছে কিনা তাও পরীক্ষা করা হয়।

 

  • মূত্র ও রক্ত পরীক্ষা : সঠিক রোগনির্নয়ের জন্য চিকিৎসক আপনাকে মূত্র বা রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তার প্যাথলজি পরীক্ষা করার পরামর্শ দিতে পারেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে কোনো সংক্রমণ রয়েছে কিনা তা সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা যায়।

 

  • ইমেজিং স্ক্যান : শরীরে টিউমারের উপস্থিতি বোঝার জন্য রোগীকে ইমেজিং স্ক্যানের সাহায্য নিতে হতে পারে। এর জন্য উপলব্ধ পরীক্ষাগুলি হল কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি (CT), এক্স-রে, পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি (PET) এবং ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI)।

 

  • বোন ম্যারো টেস্ট : এই রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা প্রায়শঃই বোন ম্যারো বা অস্থিমজ্জা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন। এই পরীক্ষা পদ্ধতি সাধারণতঃ বায়োপসি বা অ্যাসপিরেশন নামে পরিচিত। এর জন্য চিকিৎসক একটি সিরিঞ্জ বা সূঁচের মাধ্যমে কশেরুকা বা হিপ বোন থেকে প্রয়োজনীয় অস্থিমজ্জার নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর প্যাথলজিস্ট সেই নমুনা পরীক্ষা করে দেখেন যে তাতে কোনো নন-হজকিন্স লিম্ফোমার কোষ উপস্থিত আছে কিনা।

 

  • লসিকাগ্রন্থি পরীক্ষা : লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফ নোডগুলির ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করার জন্য চিকিৎসক সম্পূর্ণ গ্রন্থি বা তার একাংশের নমুনা সংগ্ৰহ করেন। এটি একধরণের বায়োপসি পরীক্ষা যার মাধ্যমে লসিকাগ্রন্থির কোষকলাগুলিকে পরীক্ষা করে তার মধ্যে নন-হজকিন্স লিম্ফোমার সাথে সম্পর্কযুক্ত কোনো টিউমার কোষ আছে কিনা তা দেখা যায়। এই বায়োপসি পরীক্ষা নন-হজকিন্স লিম্ফোমার বৈশিষ্ট্যগত অস্বাভাবিক লিম্ফোসাইট কোষ পরীক্ষা করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

নন-হজকিন্স লিম্ফোমার চিকিৎসা পদ্ধতি

নন-হজকিন্স লিম্ফোমা রোগের নানারকম চিকিৎসা সম্ভব। রোগী তাঁর পছন্দ অনুযায়ী অথবা তাঁর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী উপযুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন। যদিও রোগের বর্তমান পরিস্থিতি ও রোগীর শারীরিক অবস্থা চিকিৎসা পদ্ধতি নিরূপণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি শরীরে টিউমারের বৃদ্ধির হার কমে হয়, সেক্ষেত্রে রোগী তার বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষন করার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতেই পারেন। লিম্ফোমার উপসর্গ সাধারণতঃ খুব ধীরগতিতে শরীরে প্রকট হয়ে, ফলে এই রোগের জন্য সবসময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়না। এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসক রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষন করার জন্য এবং সুস্থতা সুনিশ্চিত করতে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে আসার পরামর্শ দিতে পারেন।

কেমোথেরাপি

কেমোথেরাপি ক্যান্সার কোষ নির্মূল করার একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসক ইনজেকশনের মাধ্যমে বা মুখে খাবার বড়ি হিসেবে ওষুধ দিতে পারেন। কেমোথেরাপির ওষুধ অনেকক্ষেত্রেই অন্যান্য ওষুধ বা চিকিৎসাপদ্ধতির সাথে একত্রে প্রয়োগ করা হয়। রোগীর শরীরে এই প্রক্রিয়ার নানারকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, যেমন চুল পড়ে যাওয়া বা বমিভাব। এছাড়াও বন্ধ্যাত্ব, হার্টের অসুখ, ফুসফুসের নানারকম ক্ষতি, এমনকি লিউকিমিয়া অব্দি দেখা দিতে পারে।

রেডিওথেরাপি

রেডিওথেরাপির মাধ্যমেও এই রোগের চিকিৎসা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন রশ্মি শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষগুলিকে ধ্বংস করা হয়। রেডিওথেরাপির দ্বারা মূলতঃ শরীরের রোগাক্রান্ত অংশগুলিতে উপস্থিত লসিকাগ্রন্থির চিকিৎসা করা হয়। রেডিওথেরাপির মেয়াদ সাধারণতঃ রোগের অবস্থা ও জটিলতার ওপর নির্ভর করে। এই পদ্ধতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলি হল চুল পড়ে যাওয়া ও ত্বকে লালচেভাব পরিলক্ষিত হওয়া। এছাড়াও, হার্টের অসুখ ও থাইরয়েডের মত জটিল প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে।

বোন ম্যারো প্রতিস্থাপন

এই চিকিৎসাপদ্ধতিতে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি মিলিতভাবে প্রয়োগ করে শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত অস্থিমজ্জার বৃদ্ধি প্রতিহত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় চিকিৎসক রোগীর শরীরে কোনো দাতার থেকে গৃহীত সুস্থ অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করেন, যার থেকে রোগীর শরীরে নিজে থেকে পুনরায় স্বাভাবিক অস্থিমজ্জা তৈরী হতে পারে।

ভারতের সেরা হাসপাতালের তালিকা

আপনি কি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে আগ্রহী? ভারতের সেরা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে মতামত এবং চিকিত্সার জন্য অনুমান পান।
Check out!

ভারতে চিকিৎসা!

আপনি যদি একজন বিদেশী নাগরিক হয়ে থাকেন যিনি ভারতে উন্নত চিকিৎসার জন্য খুঁজছেন, আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পেরে খুশি হব !

যোগাযোগ করুন

একজন রোগী-সহায়কের সাথে কথা বলুন | চিকিৎসার মতামত ও অনুমান পান | অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করুন !