ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের সবার কাছেই বেশ পরিচিত। এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, ডায়াবেটিস এখন একটি মহামারি রোগ। এই রোগের অত্যধিক বিস্তারের কারণেই সম্প্রতি এমন ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রশ্ন আসতেই পারে, ডায়াবেটিস কী? আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
আইরিশ ইনডিপেনডেন্টের খবরে বলা হয়েছে, যখন আমরা কার্বোহাইড্রেট বা সাধারণ শর্করাজাতীয় খাবার খাই, তখন তা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। ইনসুলিন হচ্ছে একধরনের হরমোন। এর কাজ হলো এই গ্লুকোজকে মানুষের দেহের কোষগুলোয় পৌঁছে দেওয়া। এরপর সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করে। সেই শক্তি দিয়েই রোজকারের কাজকর্ম করে মানুষ। সুতরাং যখন এই গ্লুকোজ শরীরের কোষে পৌঁছাবে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হবে।
যখন কারও ডায়াবেটিস হয়, তখন ওই মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। এতে করে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। সাধারণত প্রস্রাবের মাধ্যমে অতিরিক্ত গ্লুকোজ শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়। যখন প্রস্রাব বেশি হয়, তখন ডায়াবেটিসে ভোগা রোগী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন।
অন্যদিকে, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্লুকোজ বের হয়ে যায়। এতে করে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারে না দেহের কোষগুলো। ফলে রোগী দুর্বলতা অনুভব করেন। রোগী যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে তার রক্তনালি, স্নায়ু, কিডনি, চোখ ও হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
১। টাইপ-১ ডায়াবেটিস,
২। টাইপ-২ ডায়াবেটিস,
৩। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস,
8। প্রিডিয়াটিস ডায়াবেটিস
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস:
এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের বহুমূত্র হয় বেশি। সাধারণত ১০- ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। এই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতেই হয়। অন্যথায় রক্তের শর্করা অতি দ্রুত বেড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে অম্লজাতীয় বিষক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ইহা মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। এর জন্য দায়ী হল HLADR3 এবং HLADR4 নামক দুটি জিন ।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস:
টাইপ-২ রোগীদের শরীরে কিছু ইনসুলিন তৈরী হয় তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয় অথবা রোগীরা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, তাকে ব্যবহার করতে পারে না। টাইপ-২ বহুমূত্র রোগের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’। এই শ্রেণীর রোগীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রিশ বছরের ওপরে হয়ে থাকে। সাধারনত এই ধরনের রোগীরা ইনসুলিন নির্ভর নন। এই ধরনের রোগীরা সাধারনত স্থূলকায় হন। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও নিয়মিত ব্যায়ামের সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয়, টাইপ-২ ডায়বেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। খাবারে চর্বির ধরণও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স-ফ্যাট ঝুঁকি বাড়ায় পক্ষান্তরে পলি-আনস্যাচুরেটেড ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ঝুঁকি কমায়। অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়াও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স কী?
ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স কী:
ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে শরীরে ইনসুলিন তৈরি হয়। কিন্তু যা সঠিকভাবে কাজ করে না অর্থাৎ শরীরে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সঠিকভাবে কমাতে পারে না। কোনো ব্যক্তির শরীরে ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স হলে পরবর্তীতে তার ডায়াবেটিস দেখা দেয়, সাধারণত টাইপ-২ ডায়াবেটিস। ইনসুলিন রেসিস্ট্যান্স হলে সাধারণত রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, তন্ত্রাচ্ছন্ন ভাব থাকে। মস্তিষ্কস্থূলতা দেখা দেয়, ওজন বাড়ে। শরীরে চর্বি জমে, রক্তচাপ বাড়ে, ক্ষুধা ও তৃষ্ণা স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যায়।
- গর্ভকালীন বা মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস:
অনেক সময় গর্ভবতী অবস্থায় প্রসূতিদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে কিন্তু প্রসবের পর ডায়াবেটিস আর থাকে না। এই প্রকার জটিলতাকেই গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস গর্ভবতী নারী, প্রসূতি কিংবা সদ্য প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে। বিপদ এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় রোগীকে প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাধ্যমে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা দরকার হতে পারে। গর্ভবতী অবস্থায় মায়ের শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিমাণে ইনসুলিন প্রয়োজন হয়, রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখার জন্য। যদি এই ইনসুলিন তৈরিতে শরীর অক্ষম হয় তাহলে ওই গর্ভবতী মায়ের গর্ভাবস্থায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, অর্থাৎ মাতৃত্বকালীন বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হয়।
- প্রিডিয়াটিস ডায়াবেটিস:
যখন রক্তের গ্লুকোজ স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয় তবে টাইপ 2 ডায়াবেটিস হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করার পক্ষে এটি পর্যাপ্ত পরিমাণে নয়, তখন ব্যক্তির প্রিভিটিবিটিস হয়।
ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি
ডায়াবেটিস হলে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষন ও উপসর্গসমূহ দেখা যায়ঃ
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- পানি পিপাসা বেশি বেশি লাগবে
- শরীরে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হবে
- বেশি বেশি ক্ষুধা পাবে
- স্বাভাবিকভাবে খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমতে থাকবে
- যেকোনো ধরনের ক্ষত শুকাতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক দেরী হবে
- নানান রকম চর্মরোগ যেমন খোশ পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে
- চোখে কম দেখা, দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
ডায়াবেটিসের কারণগুলি
টাইপ 1 ডায়াবেটিসঃ
ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, টাইপ 1 ডায়াবেটিসে, ইমিউন সিস্টেম ইনসুলিন তৈরির জন্য দায়ী অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এই কারণে আপনার শরীরে খুব কম ইনসুলিন রয়েছে। চিনি কোষে স্থানান্তরিত না হয়ে রক্তে গঠন করে। জিনগত প্রবণতা এবং পরিবেশগত কারণগুলি টাইপ 1 ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী।
টাইপ 2 ডায়াবেটিসঃ
এই ধরণের ডায়াবেটিসে কোষগুলি ইনসুলিনের ক্রিয়া প্রতিরোধের বিকাশ ঘটায়।অগ্ন্যাশয় এই প্রতিরোধ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত ইনসুলিন উত্পাদন করতে পারে না।চিনির শক্তির জন্য কোষে স্থানান্তরিত না হয়ে রক্তে গড়া থাকে। পরিবেশগত এবং জিনগত কারণগুলির কারণে টাইপ 2 ডায়াবেটিস হয়। স্থূল লোকেরা এই ধরণের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে, টাইপ 2 ডায়াবেটিসযুক্ত প্রত্যেকেরই স্থূল বা ওজনযুক্ত নয়।
গর্ভাবস্থা ডায়াবেটিসঃ
গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হ’ল গর্ভাবস্থা বজায় রাখতে এবং গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা হরমোন তৈরি করে। আপনার কোষগুলি এই হরমোনের কারণে ইনসুলিনের প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। অগ্ন্যাশয় এই প্রতিরোধকে কাটিয়ে উঠতে অতিরিক্ত ইনসুলিন উত্পাদন করে। অগ্ন্যাশয় খুব অল্প গ্লুকোজ ধারণ করতে অক্ষম হলে, এটি রক্ত প্রবাহে অনেক পিছনে রেখে কোষগুলিতে প্রবেশ করে।এটি গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের কারণ হয়।
প্রিডাইটিসঃ
প্রাক-ডায়াবেটিস প্রায়শই টাইপ 2 ডায়াবেটিসের দিকে পরিচালিত করে।
ডায়াবেটিস নির্ণয়
- ৪৫ বছরের বেশি বয়সের লোকদের ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি পরীক্ষা করা উচিত এবং রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। যদি তারা দেখতে পান যে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে তবে প্রতি তিন বছর পর পর তাদের পরীক্ষা করা উচিত।
- হার্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ, বা কোলস্টেরল অস্বাভাবিক মাত্রার মতো অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে 25 এরও বেশি (এশিয়ান আমেরিকানদের জন্য 23)বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) রয়েছে এমন লোকদের ডায়াবেটিসের জন্য পরীক্ষা করা উচিত।
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের প্রতি তিন বছরে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা উচিত।
- প্রিডিবিটিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে বছরে একবার টাইপ 2 ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা উচিত।
সকল ধরণের ডায়াবেটিসের চিকিত্সার বিকল্প
স্বাস্থ্যকর খাদ্য
ব্যায়াম
অনেক লোক দৈনিক ভিত্তিতে ব্যায়াম করে এবং আপনি যদি ডায়াবেটিক ব্যক্তি হন তবে অবশ্যই আপনার অনুশীলনের পরিকল্পনাটি অনুসরণ করা উচিত। অনুশীলন আপনার ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে। ফলস্বরূপ, কোষগুলিতে চিনি পরিবহনের জন্য আপনার দেহের কম ইনসুলিনের প্রয়োজন হবে। চিনি কোষে প্রবেশের সাথে সাথে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। কোষগুলি এই চিনিটি শক্তির জন্য ব্যবহার করে। আপনার প্রতিদিনের রুটিনে অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত করুন। 30 মিনিটের অনুশীলন আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে।