মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সার (হেড ও নেক ক্যান্সার)
যে রোগে ঘাড় ও গলার কোষগুলি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায় এবং তার সাথে সাথে রক্ত ও লসিকা সংবহনের মাধ্যমে দ্রুত আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে দেহের অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতিসাধন করে, তাকে হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার বলে।
এই ক্যান্সার মূলতঃ ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্র, গলা, ঠোঁট, মুখগহ্বর, নাক এবং লালগ্রন্থিতে হয়।
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের কারণ
- অতিরিক্ত ধূমপান এবং অত্যধিক মদ্যপান হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের অন্যতম কারণ
- দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যালোকে শরীরের কোনো অঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় থাকার ফলে সেইসব অংশের ত্বকে ক্যান্সার হতে পারে
- হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসও (HPV) হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে
- মুখ ও দাঁত অপরিষ্কার থাকা এবং দুর্বল স্বাস্থ্যবিধি
- শরীরের দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
- কাজের পরিবেশে বিভিন্ন রকম ক্ষতিকর পদার্থ যেমন অ্যাসবেস্টাস, কাঠের গুঁড়ো বা ধোঁয়া, রঙের বাষ্প ইত্যাদির উপস্থিতিতে শ্বাস নেওয়াও হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সার হবার একটি বড় কারণ।
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের লক্ষণ ও উপসর্গ
- দীর্ঘ দিন যাবৎ গলা ব্যথা
- মুখে লাল বা সাদা রঙের দাগ
- লালার সাথে রক্ত ক্ষরণ
- গলার কাছে ফোলা ভাব, যা দীর্ঘ সময় পরও নিরাময় হতে চায়না
- চিবানো, ঢোক গেলা বা চোয়াল ও জিভ নাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যথা ও অস্বস্তি ভাব
- দীর্ঘ দিন যাবৎ নাক বন্ধ থাকা
- হাইজিন বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সত্ত্বেও মুখে দুর্গন্ধ হওয়া
- দীর্ঘদিন ধরে সর্দির সমস্যা
- ঘন ঘন মাথা ব্যথা হওয়া
- কানে কম শোনা
- মুখ বা মুখের অংশ অসাড় হয়ে যাওয়া
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের রোগ নিরূপণ
- শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে গলা, ঘাড়, ঠোঁট, মাড়ি বা গালে কোনো ফোলা ভাব আছে কিনা দেখা
- প্রস্রাব ও রক্ত পরীক্ষা
- এন্ডোস্কোপি নামক পরীক্ষার মাধ্যমে হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের উপস্থিতি পরীক্ষা করা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ মাথা ও গলার অভ্যন্তরে এন্ডোস্কোপ নামক একটি ছোট ক্যামেরা বিশিষ্ট নলের মত যন্ত্র প্রবেশ করিয়ে ছবি তুলে ওই নির্দিষ্ট অঙ্গগুলির ভেতরের অবস্থা পর্যবেক্ষন করতে পারেন।
- বায়োপসি নামক পরীক্ষার মাধ্যমেও এই রোগ নিরূপণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত অঙ্গের থেকে কিছু পরিমাণ কোষের নমুনা সংগ্ৰহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে তার মধ্যে ক্যান্সার কোষ রয়েছে কিনা। বায়োপসির মাধ্যমে রোগীর শরীরে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) রয়েছে কিনা তাও বোঝা যায়।
- টিউমারের আকার এবং প্রকৃতি বোঝার জন্য সিটি স্ক্যান পরীক্ষা
- ম্যাগনেটিক রেজন্যান্স ইমেজিং বা এম আর আই পরীক্ষার মাধ্যমেও টিউমারের আকার জানা যায়।
- বোন স্ক্যান বা হাড়ের স্ক্যান করে জানা যায় যে শরীরের হাড় গুলিতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা
- PET- CT স্ক্যানের দ্বারা চিকিৎসার সাফল্য জানা যায়। এবং এই একই পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সার পুনরায় ফিরে এসেছে কিনা তাও জানা যায়।
মাথা ও ঘাড়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি
সার্জারি
হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের চিকিৎসায় সার্জারি বা অপারেশনই প্রথম ও সর্বপ্রধান চিকিৎসা। বিশেষতঃ এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে সার্জারি বিশেষভাবে কার্যকরী হয়। হেড অ্যান্ড নেক ক্যান্সারের জন্য উপলব্ধ বিভিন্ন সার্জারিগুলি হল-
- ল্যারিঞ্জেক্টমি: এই পদ্ধতিতে মূলতঃ স্বরযন্ত্রের অপারেশন করা হয়। এটি দুইপ্ৰকার- সম্পূর্ণ বা টোটাল এবং আংশিক বা পার্শিয়াল ল্যারিঞ্জেক্টমি। স্বরযন্ত্রের ছোট আকারের ক্যান্সারের জন্য আংশিক বা পার্শিয়াল ল্যারিঞ্জেক্টমি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই অপারেশনে শুধুমাত্র স্বরযন্ত্রের ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি কেটে বাদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ক্যান্সার আক্রান্ত অংশের পরিমাণ যদি অত্যধিক হয়, তবে সেক্ষেত্রে টোটাল ল্যারিঞ্জেক্টমি করতে হয়। এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ স্বরযন্ত্রটিই কেটে বাদ দিতে হয়।
- গলা ও ঘাড়ের অপারেশন: যদি আপনার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মনে করেন যে ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে, তবে তিনি ঘাড়ের লসিকাগ্রন্থি বা লিম্ফ নোড অপারেশন করে নাদ দেবার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
- ফ্ল্যাপ সার্জারি: এই ধরণের অপারেশনে ক্যান্সার আক্রান্ত টিস্যু প্রতিস্থাপন করা হয়। প্রতিস্থাপিত টিস্যুগুলি কেবলমাত্র সফ্ট টিস্যু বা অস্থি ও সফ্ট টিস্যু দুইই হতে পারে।
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি হল মূলতঃ একটি ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ বা চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা শরীরের অভ্যন্তরে অতি দ্রুতহারে বাড়তে থাকা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলির বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করে এবং তাদের নির্মূল করে। এই ওষুধ সাধারণতঃ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
যদিও কেমোথেরাপির বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা সত্ত্বেও এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিয়েশন বা ক্যান্সারের অপারেশনের চাইতে আলাদা। কারণ, রেডিয়েশন থেরাপি বা অপারেশন ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্য করে চিকিৎসা করে। অন্যদিকে, কেমোথেরাপির ওষুধ মেটাস্টেসিস পর্যায়ে থাকা অর্থাৎ দেহের অন্যান্য অংশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার সেলগুলিকেও ধংস করতে সক্ষম। (আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন: কেমোথেরাপি)