ভেরিকোস ভেইন
ভেরিকোস ভেইন এমন একটি রোগ যাতে হাত ও পায়ের শিরাগুলি গিঁট পাকানোর মত হয়ে ফুলে ওঠে। এই ফুলে ওঠা শিরা ত্বকের ঠিক নীচেই দেখা যায়। এই অবস্থায় শিরাগুলি গাঢ় বেগুনী বা নীলাভ রঙের হয়ে ওঠে।
বেশিরভাগ ভেরিকোস ভেইন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমস্যাটি বাহ্যিক বা দেখতে অস্বাভাবিক লাগাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু কারো কারোর ক্ষেত্রে এর অতিরিক্ত কিছু সমস্যা, যেমন চুলকানি, ব্যথা, ফুলে ওঠা, খিঁচুনি, আক্রান্ত অংশের ত্বকের রঙ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। সুতরাং, এইসব ব্যক্তির ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার আশু প্রয়োজন হয়।
কারণ
মানবদেহে শিরা হল রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। আমাদের হার্ট বা হৃদয় শরীরের সমস্ত অংশে বিশুদ্ধ রক্ত পাম্প করে। এই রক্ত আর্টারি বা ধমনীর মাধ্যমে দেহের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে পড়ে। অতঃপর শরীরের সমস্ত অংশের দূষিত রক্ত পরিশ্রুত হবার জন্য শিরার মাধ্যমে হার্টে ফিরে আসে। প্রতিটি শিরার মুখে একটি ক্ষুদ্র ভালভ বা কপাটিকা থাকে, যা রক্তের প্রবাহকে উল্টো দিকে ফিরে যেতে বাধা দেয়। এই ভালভগুলি যদি কাজ করতে অক্ষম হয়, তখন ভেরিকোস ভেইন রোগের প্রাদুর্ভাব হয়।
ভেরিকোস ভেইনের লক্ষণ ও উপসর্গ
- পায়ের পাতা ও পা ফুলে ওঠা এবং যন্ত্রনা
- পায়ের নিচের অংশের পেশীতে খিঁচুনি
- শিরার আশেপাশের অংশে চুলকানি
- আক্রান্ত অংশের চারপাশের ত্বকের রঙ পরিবর্তন
স্পাইডার ভেইন ও ভেরিকোস ভেইন
স্পাইডার ভেইন ও ভেরিকোড ভেইন দুটি আলাদা রোগ।
ভেরিকোস ভেইন নামক রোগে পায়ের শিরাগুলি বড় আকারে গিঁট পাকিয়ে ফুলে ওঠে। এইরকম শিরার অস্বাভাবিক গঠন সাধারণতঃ পায়ে এবং পায়ের পাতায় দেখা যায়। এই অস্বাভাবিক গঠন চামড়ার ওপর থেকেই স্পষ্ট দেখা যায়।
অন্যদিকে, স্পাইডার ভেইন তুলনায় আকারে ছোট এবং এই অসুখে শিরাগুলি লাল, বেগুনী বা নীল হয়ে যায়। এই স্পাইডার ভেইন সাধারনতঃ পা, বুক বা মুখের শিরায় দেখা যায়।
ভেরিকোস ভেইনের কারণ ও ঝুঁকির সম্ভাবনা
- পরিবারে কারোর ভেরিকোস ভেইনের পূর্ব ইতিহাস থাকা
- বয়সের সাথে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে
- স্থূলতা বা ওবেসিটি
- দীর্ঘ সময় ধরে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস
- খতিগ্রস্ত ভালভ বা কপাটিকা
- পায়ে এবং পেটে অতিরিক্ত চাপ পড়া
ভেরিকোস ভেইনের চিকিৎসা
নিজের যত্ন
চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করার পূর্বে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি পালন করে এই রোগের নিরাময় সম্ভব-
- শরীরচর্চা: নিয়মিত শরীরচর্চার ফলে দেহের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়। এর ফলে বাধাপ্রাপ্ত ভালভের মুখ খুলে গিয়ে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।
- ওজন কমানো: পায়ে অতিরিক্ত ভার পড়লে ভেরিকোস ভেইন হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই যথাসম্ভব অতিরিক্ত ওজন কমান।
- আঁটোসাঁটো জামাকাপড় পরবেন না
- বসার সময় পা তুলে বসা অভ্যেস করুন
- দীর্ঘক্ষন দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হলে কিছুক্ষন অন্তর অন্তর নিজের অবস্থান পরিবর্তন করুন
কম্প্রেশন মোজা
ভেরিকোস ভেইনের চিকিৎসা কারা করেন?
ভাস্কুলার সার্জেনরা সাধারনতঃ এই রোগের চিকিৎসা করে থাকেন। এছাড়াও ত্বক বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ ডার্মাটোলজিস্ট এবং কসমেটিক সার্জেনরা এই রোগের চিকিৎসা করতে সক্ষম।
চিকিৎসা ব্যবস্থা
ফোম স্ক্লেরোথেরাপি
এন্ডোভেনাস লেজার থেরাপি
রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাব্লেশন
সার্জারি বা অপারেশন
ভেরিকোস ভেইন চিকিৎসায় কার্যকরী সার্জারি বা অপারেশনগুলি হল-
- হাই লাইগেশন এবং ভেইন স্ট্রিপিং: এই প্রণালীতে আক্রান্ত উপশিরা মূল শিরায় যুক্ত হবার পূর্বে বেঁধে দেয়া হয় এবং অপারেশনের মাধ্যমে তা কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এইভাবে শিরা কেটে বাদ দিলে তা শরীরের স্বাভাবিক রক্ত চলাচলে কোনো রকম প্রভাব ফেলে না, কারন আরো গভীরে অবস্থিত শিরাগুলি রক্ত সংবহনে সহায়তা করে। এই অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজন হয়না এবং এটি সাধারণত ও পি ডি অর্থাৎ আউট পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট (হসপিটালের বহির্বিভাগ) থেকেই সম্পন্ন হয়।
- অ্যামবুলেটরি ফ্লেবেক্টমি: এই প্রণালীতে সার্জেন পায়ে একটি ছোট জায়গা কেটে ভেরিকোস ভেইনটির অপারেশন করেন।
- এন্ডোস্কোপিক ভেইন সার্জারি: যখন ভেরিকোস ভেইন গুরুতর আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য কোনো সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি আর কাজ করে না , তখন চিকিৎসকেরা এই এন্ডোস্কোপিক ভেইন সার্জারির সুপারিশ করে থাকেন। পায়ে ভেরিকোস ভেইনের কারণে আলসার বা ঘা তৈরি হলেও এই সার্জারি কার্যকরী হয়। এই প্রণালীতে এন্ডোস্কোপ নামক একটি সরু নলাকার যন্ত্র, যার মাথায় একটি ছোট ক্যামেরা লাগানো থাকে, পায়ে একটি ছোট অংশ কেটে তার মধ্যে দিয়ে শিরায় প্রবেশ করানো হয়। এবং তারপর যন্ত্রের মাধ্যমে আক্রান্ত শিরাটি কেটে বাদ দেওয়া হয়। অন্যান্য অপারেশনের মতই এই প্রণালীর জন্যও হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রয়োজন হয়না এবং বহির্বিভাগেই এই চিকিৎসা হয়।