গ্রেভ’স ডিজিজ
গ্রেভ’স ডিজিজ একটি অটোইমিউন রোগ, যাতে শরীরে থাইরয়েড হরমোন তৈরী হবার মাত্রা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এই অবস্থা অ্যান্টিবডি কে হাইপারথাইরয়েডিজম বলা হয়। এই অসুখ সাধারণতঃ মহিলা ও ৪০বছরের ঊর্ধ্বে বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়।
গ্রেভ’স ডিজিজের কারণ
শরীরের নিজস্ব রোগপ্ৰতিরোধ ক্ষমতার দুর্বলতা অথবা আভ্যন্তরীণ গোলযোগই এই রোগের জন্য দায়ী। মানবদেহের ইমিউনিটি বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা শরীরে তৈরী করে, যা নির্দ্দিষ্ট ব্যাক্টিরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য রোগজীবাণুকে প্রতিহত করে আমাদের সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচায়। কিন্তু, গ্রেভ’স ডিজিজ হলে এই ইমিউনিটি সিস্টেম থাইরয়েড গ্রন্থির (গলায় অবস্থিত একটি গ্রন্থি, যা থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন করে) কেবলমাত্র অংশবিশেষে অ্যান্টিবডি উৎপাদন করে। থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকলাপ মূলতঃ পিটুইটারী নামক একটি গ্ল্যান্ড (Thatযা মাস্তিষ্কের পাদদেশে অবস্থান করে) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। থাইরয়েড রিসেপ্টর অ্যান্টিবডি (TRAb), যা গ্রেভ’স ডিজিজের ফলে উৎপন্ন হয়, শরীরে নিয়ন্ত্রণকারী পিটুইটারীর মত আচরণ করতে থাকে। এর ফলে থাইরয়েড রিসেপ্টর অ্যান্টিবডি (TRAb) সাধারণ থাইরয়েডের নিয়ন্ত্রণকে উল্লঙ্ঘন করে যায়, এবং এই কারণেই শরীরে থাইরয়েডের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়।
গ্রেভ’স ডিজিজের উপসর্গ
এই রোগের লক্ষণ বা উপসর্গগুলি হল:
- গরমে অতিরিক্ত কষ্ট পাওয়া
- অ্যাংজাইটি বা দুশ্চিন্তা
- ক্লান্তি
- অতিরিক্ত স্বেদ (ঘাম হওয়া)
- লিঙ্গের কর্মক্ষমতা ও যৌন সংবেদনশীলতা হ্রাস পাওয়া
- খিটখিটে স্বভাব
- চোখ ফুলে ওঠা (গ্রেভ’স অপথ্যালমোপ্যাথি)
- উষ্ণ, আর্দ্র ত্বক
- বুক ধড়ফড় করা (দ্রুত ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন)
- হাত ও হাতের আঙুলে মৃদু কম্পন
- ওজন কমে যাওয়া
- ঘুমের ব্যাঘাত
- পায়ের পাতায় ও জঙ্ঘাস্থির (শিন বোন) ওপরের ত্বকে লালচে, পুরু চামড়া (গ্রেভ’স ডার্মোপ্যাথি)
- থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি (গয়টার)
গ্রেভ’স ডিজিজের রোগ নিরূপণ
গ্রেভ’স ডিজিজ চিহ্নিত করার জন্য চিকিৎসক কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারেন। এছাড়াও সঠিক রোগনির্নয়ের জন্য রোগীর শারীরিক ও অসুখের ইতিবৃত্তান্ত জানাও খুবই জরুরী।
- রক্ত পরীক্ষা: রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে থাইরয়েড সিমুলেটিং হরমোন বা TSH এর পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায়। এই TSH হরমোন হল একধরণের পিটুইটারী হরমোন, যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে উদ্দীপিত হতে সাহায্য করে। এছাড়াও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের পরিমাণও জানা যায়। যদি কেউ গ্রেভ’স ডিজিজে আক্রান্ত হন, তবে তাঁর শরীরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম মাত্রায় TSH এবং বেশী পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন লক্ষ্য করা যাবে।
- আল্ট্রাসাউন্ড: এই পদ্ধতিতে উচ্চ-কম্পাঙ্কের শব্দ-তরঙ্গ শরীরে প্রবেশ করিয়ে শরীরের অভ্যন্তরের ছবি তোলা হয়। এর মাধ্যমে দেহে কোন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়েছে কিনা জানা যায়। এই পরীক্ষার মাধ্যমে থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধি সুনিশ্চিতভাবে জানা যায়। যেসব ব্যক্তি রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন আপটেক চিকিৎসা গ্রহণে অক্ষম, (যেমন গর্ভবতী মহিলারা) তাঁদের ক্ষেত্রে এই আল্ট্রাসাউন্ড অত্যন্ত কার্যকরী একটি পরীক্ষা।
- রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন আপটেক: এক্ষেত্রে সম্পর্কিত চিকিৎসক কিছু পরিমাণ রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন শরীরে প্রবেশ করিয়ে থাইরয়েড গ্রন্থির আয়োডিন গ্রহণের মাত্রা নির্ধারণ করবেন। এই মাত্রা নির্ধারণ করার জন্য উন্নত স্ক্যানিং ক্যামেরার সাহায্য নেওয়া হয়। শরীরের রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন গ্রহণ করার ক্ষমতা দেখে বর্তমান অসুখের কারণ গ্রেভ’স ডিজিজ না অন্যা কোন হাইপারথাইরয়েডিজম অর্থাৎ থাইরয়েডের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, তা চিকিৎসক বলতে পারেন।
- ইমেজিং টেস্ট: রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসক উন্নতনিমেজিং টেস্ট, যেমন MRI বা সিটি স্ক্যান করানোর পরামর্শ দিতে পারেন।
গ্রেভ’স ডিজিজের সম্ভাব্য চিকিৎসা
রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন থেরাপি
এই পদ্ধতিতে রোগীর মুখে রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়োডিন (রেডিওআয়োডিন) দেওয়া হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি এই রেডিওআয়োডিন নিজের কোষে গ্রহণ করে এবং তারপর, এই আয়োডিনের বিকিরণ সময়ের সাথে সাথে থাইরয়েড গ্রন্থির অতিমাত্রায় কার্যকর কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। ফলস্বরূপ, থাইরয়েড গ্রন্থি নিজের স্বাভাবিক আকারে ফিরে যায় এবং রোগের লক্ষনগুলিও ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার জন্য কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস পর্য্যন্ত সময় লাগতে পারে। যদিও, এই চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রেভ’স অপথ্যালমোপ্যাথি হবার সম্ভাবনা বা বাড়িয়ে তোলে। এই চিকিৎসা গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে বর্জনীয়।
থাইরয়েড-রোধক ঔষধ
এই ঔষধগুলি আয়োডিনের সাথে বিক্রিয়া করে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে হরমোন নিঃসরণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই রোগের চিকিৎসার জন্য চিকিৎসক মেথিমেজোল বা প্রোপাইলথিওরাসিল জাতীয় ঔষধ দিতে পারেন। সাধারণতঃ মেথিমেজোল (ট্যাপাজোল) হল এই রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের প্রথম পছন্দ। যদিও গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভাবস্থার প্রথম তিনমাসের সময়কালের জন্য প্রোপাইলথিওরাসিল উপযুক্ত ঔষধ। এই দুইপ্রকার ঔষধ যদি অন্যান্য কোনো ঔষধ বা চিকিৎসাদি ব্যতিরেকে প্রয়োগ করা হয়, তবে হাইপারথাইরয়েডিজম পুনরায় দেখা দিতে পারে। উপরন্তু এক বছরের বেশী এই ঔষধ গ্রহণ করলে এর দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে। এই ঔষধগুলি ছাড়াও অতিরিক্ত পদক্ষেপ হিসেবে রেডিওআয়োডিন চিকিৎসার আগে বা পরে অ্যান্টিথাইরয়েড জাতীয় ঔষধ নেওয়া যেতে পারে।
বিটা ব্লকার
বিটা ব্লকার জাতীয় ঔষধ থাইরয়েড উৎপাদন বন্ধ করেনা, বরং শরীরকে থাইরয়েডের নানারকম প্রভাব হতে রক্ষা করে। এই ঔষধগুলি হাত-পা কাঁপা, গরমে কষ্ট হওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অতিরিক্ত স্বেদনিঃসরণ, পেশীর দুর্বলতা, অ্যাংজাইটি, উদরাময় (ডায়রিয়া), এবং খিটখিটে স্বভাব থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। কিন্তু যেসব ব্যক্তির শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের বিটা ব্লকার থেকে সর্বতোভাবে দূরে থাকাই শ্রেয়, কেননা এই ঔষধ শ্বাসকষ্টের প্রভাব বাড়িয়ে দিতে পারে। এই ঔষধ মধুমেহ রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।
সার্জারি
সঠিক জীবনযাপন ও ঘরোয়া উপচার
- মানসিক চাপ থেকে মুক্তি: মানসিক চাপ গ্রেভ’স ডিজিজের সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে। এর থেকে রেহাই পেতে অবশ্যই চাপমুক্ত থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে গান শোনা বা ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করা লাভদায়ক হতে পারে। সঠিক জীবনশৈলী নির্ধারণ করতে অবিলম্বে চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে আপনার রোজনামচায় ব্যায়াম, পুষ্টিকর খাবার ও বিনোদনের উপায় যোগ করুন।
- সঠিক খাওয়া দাওয়া ও শরীরচর্চা: সুষম আহার ও নিয়মিত শরীরচর্চা রোগের উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এই অভ্যাস স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। এছাড়াও, ওজন তোলার ব্যায়ামগুলি হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।