কার্সিনয়েড টিউমার
কার্সিনয়েড টিউমার হল দেহের নিউরোএন্ডোক্রিন গ্রন্থির ক্যান্সার। এই নিউরোএন্ডোক্রিন গ্রন্থি মানবদেহে হরমোন উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। কার্সিনয়েড টিউমার একটি অত্যন্ত বিরল প্রজাতির ক্যান্সার। এই টিউমার সাধারণতঃ অন্ত্র বা অ্যাপেন্ডিক্স অংশে দেখা যায়।
এছাড়াও পাকস্থলী, অগ্ন্যাশয় বা প্যাংক্রিয়াস, ফুসফুস, স্তন, যকৃৎ বা কিডনি, ডিম্বাশয় বা ওভারি এবং শুক্রাশয় ইত্যাদি অঙ্গেও এই টিউমার হতে পারে।
কার্সিনয়েড টিউমারের লক্ষণ ও উপসর্গ
কার্সিনয়েড টিউমারের উপসর্গ সাধারণতঃ এই টিউমারের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
- বাওয়েল বা মলাশয়ের কার্সিনয়েড টিউমারের ক্ষেত্রে তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। এছাড়াও ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য, এবং মলত্যাগের সময় রক্তপাত এই রোগের প্রধান লক্ষণ।
- ফুসফুসে কার্সিনয়েড টিউমার হলে কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং হাঁপানি, ক্লান্তি এবং সর্বোপরি বুকে প্রবল ব্যথা অনুভূত হয়।
- পেটে বা পাকস্থলীতে কার্সিনয়েড টিউমার ক্ষিদে কমিয়ে দেয়। এছাড়াও ক্লান্তি এবং পেটে ব্যথা এই প্রকার টিউমারের সাধারণ লক্ষণ।
কার্সিনয়েড টিউমারের কারণ ও অন্যান্য ঝুঁকির সম্ভাবনা
কার্সিনয়েড টিউমারের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। যদিও গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে এই রোগের কারণ বলে অনুমান করেন। এইগুলি হলো:
পরিবারে কারো মাল্টিপল এন্ডোক্রিন নিওপ্লাসিয়া টাইপ 1 (MEN1) নামক রোগের ইতিহাস থাকলে কার্সিনয়েড টিউমার হবার ঝুঁকি থাকে।
- কোনো ব্যক্তি যদি দীর্ঘদিন যাবৎ মধুমেহ অর্থাৎ ডায়বেটিস রোগে আক্রান্ত থাকেন তবে তাঁর এই রোগ হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি হয়।
- পাকস্থলীর আভ্যন্তরীণ পর্দা বা স্টমাক লাইনিং ফুলে ওঠা থেকেও কার্সিনয়েড টিউমার হতে পারে।
- অত্যধিক ধূমপান ও মদ্যপান থেকেও এই ক্যান্সার হতে পারে।
- স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়াও কার্সিনয়েড টিউমার হবার একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
কার্সিনয়েড টিউমারের রোগ নিরূপণ বা ডায়াগনোসিস
এই রোগ হয়েছে কিনা বোঝার জন্য চিকিৎসকেরা সাধারণতঃ যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন, সেগুলি হলো:
- মূত্র পরীক্ষা – এই পরীক্ষার মাধ্যমে রক্তে অবস্থিত সেরোটোনিন নামক পদার্থের মাত্রা জানা যায়
- পি ই টি- সিটি স্ক্যান (PET- CT Scan) – এই পদ্ধতিতে টিউমারটির অবস্থান ও আকার পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও শরীরের অন্যান্য কোনো অংশে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়েছে কিনা তাও এই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়।
- এম আর আই (MRI) – এই ইমেজিং পরীক্ষার মাধ্যমে চৌম্বক ক্ষেত্র ও বেতার তরঙ্গের সাহায্যে দেহের প্রস্থচ্ছেদের ছবি তোলা হয়। এই ছবি থেকে দেহের অভ্যন্তরের অবস্থা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।
- কোলনোস্কপি: বাওয়েল কার্সিনয়েড টিউমার পরীক্ষা করার জন্য এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
- বায়োপসি – শরীরের আক্রান্ত অংশের থেকে নমুনা সংগ্ৰহ করে তা গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয় যে তাতে ক্যান্সার কোষ বর্তমান আছে কিনা।
- এন্ডোস্কোপি – এটিও শরীরের অভ্যন্তরের ছবি তোলার একটি পদ্ধতি, এবং এর মাধ্যমে শরীরে কোথাও কার্সিনয়েড টিউমার হয়েছে কিনা তা জানা যায়।
কার্সিনয়েড টিউমারের চিকিৎসা
সার্জারি বা অপারেশন
সার্জারি: কার্সিনয়েড টিউমার অপারেশনের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল
- অ্যাপেন্ডোইকটেক্টমি: এই পদ্ধতিতে সার্জারির মাধ্যমে অ্যাপেন্ডিক্স কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
- কোলেক্টমি: এই পদ্ধতিতে কোলন বা বৃহদ্রন্ত্র বাদ দেওয়া হয়।
- হেপাটিক আর্টারি এম্বোলাইজেশন: এই অপারেশনের দ্বারা কার্সিনয়েড টিউমারে অবস্থিত দূষিত রক্তের প্রবাহ লিভারে পৌঁছনো থেকে রোধ করা হয়।
- সোম্যাটোস্ট্যাটিন অ্যানালগস: এই সার্জারির ফলে দেহে অতিরিক্ত হরমোন উৎপাদন হওয়া বন্ধ হয়, যার ফলে টিউমারের বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি হল মূলতঃ একটি ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ বা চিকিৎসা ব্যবস্থা, যা শরীরের অভ্যন্তরে অতি দ্রুতহারে বাড়তে থাকা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলির বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করে এবং তাদের নির্মূল করে। এই ওষুধ সাধারণতঃ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলা ক্যান্সার সেল বা কোষগুলিকে ধ্বংস করার মাধ্যমে ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
যদিও কেমোথেরাপির বেশ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, তা সত্ত্বেও এটি ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচলিত পদ্ধতি। এই চিকিৎসা পদ্ধতি রেডিয়েশন বা ক্যান্সারের অপারেশনের চাইতে আলাদা। কারণ, রেডিয়েশন থেরাপি বা অপারেশন ক্যান্সারে আক্রান্ত কোষগুলিকে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে লক্ষ্য করে চিকিৎসা করে। অন্যদিকে, কেমোথেরাপির ওষুধ মেটাস্টেসিস পর্যায়ে থাকা অর্থাৎ দেহের অন্যান্য অংশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার সেলগুলিকেও ধংস করতে সক্ষম। (আরও বিস্তারিত জানতে পড়ুন: কেমোথেরাপি)