ব্রেন টিউমারের লক্ষণ ও উপসর্গ
ব্রেন টিউমার মূলতঃ দুই প্রকার হয়, ম্যালিগন্যান্ট অর্থাৎ ক্যান্সারের সম্ভাবনা যুক্ত এবং বিনাইন অর্থাৎ ক্যান্সারের সম্ভাবনা বিহীন। টিউমারের এই প্রকৃতি তার অবস্থান, আকার, ছড়িয়ে পড়ার হার এবং ক্যান্সার কোষগুলির বিভাজনের মাত্রার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই ব্রেনের টিউমার প্রাথমিক অবস্থায় ধরা যায়না, বা এর কোনো উপসর্গ দেখা যায়না। কিন্তু বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই ব্রেন টিউমারের কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষণ ও উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়, যার দ্বারা সহজেই এই রোগ চিহ্নিত করা সম্ভব হয়।
এই রোগের উপসর্গগুলি সাধারণ এবং সুনির্দিষ্ট এই দুই ধরনেরই হতে পারে।
ব্রেন টিউমারের সাধারণ উপসর্গের ক্ষেত্রে টিউমারটি ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মস্তিষ্কন সুষুম্নাকাণ্ডে (মেরুদণ্ডের ভিতরে) প্রবল চাপের সৃষ্টি করে, এবং ফলস্বরূপ ব্রেন টিউমারের সাধারণ লক্ষনগুলির সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, ব্রেন টিউমারে সুনির্দিষ্ট লক্ষণ দেখা যাওয়ার প্রধান শর্ত হল মস্তিষ্কের কোনো বিশেষ অংশ গভীরভাবে ক্যান্সারের দ্বারা প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই প্রভাবের ফলে ওই নির্দিষ্ট অংশে রোগের উপসর্গগুলি বারংবার দেখা দিতে থাকে।
এই দুই ধরণের উপসর্গ নিরূপণ করার জন্যই নির্দিষ্ট পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োজন হয়। এবং এই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে মস্তিষ্কে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় টিউমার উপস্থিত রয়েছে কিনা, তা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়।
ব্রেন টিউমারের সাধারণ উপসর্গ
মাথা ব্যথা
এই অসুবিধা ব্রেন টিউমারের একটি অতি পরিচিত উপসর্গ। প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেই রোগের প্রাথমিক অবস্থায় এই উপসর্গ লক্ষ্য করা যায়। টিউমার আকারে বৃদ্ধি পেলে তা মস্তিষ্ক এবং পার্শ্ববর্তী স্নায়ু ও রক্তজালিকাগুলিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে, যার ফলে এই ব্যথার অনুভব হয়। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী তার মাথা ব্যথার ধরণে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তীব্র মাথা ব্যথা অনুভব করা
- সারাদিন ধরে মাথা ব্যথা থাকা, কিন্তু দিনের বিভিন্ন সময়ে তার তীব্রতার পরিবর্তন লক্ষ্য করা
- ব্যায়াম করার সময়, বেশি নড়াচড়া করলে বা কাশলে বেশি ব্যথা অনুভব করা
- অতিরিক্ত মাথা ব্যথার কারণে বিভিন্ন উপসর্গ যেমন বমি ভাব অনুভব করা
- সাধারণ ব্যথার ওষুধ খাওয়া সত্বেও মাথা ব্যথা না কমা
মনে রাখবেন, যে কোনো ধরণের মাথা ব্যথাই কিন্তু ব্রেন টিউমারের উপসর্গ নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা, স্ট্রেস বা মানসিক চাপ ইত্যাদির কারণেও মাথা ব্যথা হতে পারে। যদি দীর্ঘদিন ধরে মাথা ব্যথা না কমে, তবে অবিলম্বে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিৎ।
ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন
ব্রেন টিউমারের ফলে হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ হওয়া, এমনকি আপনার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই সংক্রান্ত যে সমস্ত পরিবর্তন সর্বাধিক দেখা যায়, সেগুলি হলো:
- ছোটখাটো, সাধারণ বিষয়ে বিরক্তি অনুভব করা, এবং এই বিরক্তি ভাব দীর্ঘ সময় ধরে স্থায়ী হওয়া
- বাইপোলার মুড চেঞ্জ, অর্থাৎ কোনো উল্লেখযোগ্য কারণ ছাড়াই এক মুহূর্ত হাসিখুশি অবস্থা থেকে পরমুহূর্তেই দুঃখ বা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া
- ক্লান্তি, কাজ করতে গড়িমসি ভাব, অথবা রোজকার কাজ করতে অনীহা
- কোনো কাজ, যা পূর্বে আপনার প্রিয় ছিল, বর্তমানে তার প্রতি কোনো টান বা ঝোঁক না থাকা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি হয়তো আপনার প্রিয় শখ বা হবিকেই ঘৃণা করতে শুরু করতে পারেন।
- ছোটখাটো, সাধারণ বিষয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়া
নিম্নলিখিত অঙ্গ বা দেহাংশে টিউমারের উপস্থিতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন দেখা দেওয়ায় সম্ভাবনা সর্বাধিক:
- ফ্রন্টাল লোব বা মস্তিষ্কের অগ্রভাগ
- টেম্পোরাল লোব অর্থাৎ মস্তিষ্কের পশ্চাদভাগ
- সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্কের কোনো অংশ
খিঁচুনি
আমাদের স্নায়ুর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বৈদ্যুতিক প্রৈতি (ইম্পালস) মস্তিষ্ক থেকে দেহের অন্যান্য অংশে নির্দেশ প্রেরণ করার কাজে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। যদি মস্তিষ্কে টিউমারনজন্ম নেয়, তবে তা নিজের বৃদ্ধির সাথে সাথে স্থান সঙ্কুলানের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট স্নায়ু ও রক্তজালিকা গুলিকে চাপ দিতে থাকে। এর ফলস্বরূপ স্নায়ুর বৈদ্যুতিক প্রবাহ ব্যাহত হয়, যার জন্য খিঁচুনির মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
এই খিঁচুনিও ব্রেন টিউমারের একটি অত্যন্ত সাধারণ উপসর্গ, যা ৫০ শতাংশেরও বেশি ব্রেন টিউমার রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক মাংসপিন্ড গঠন হওয়ায় ব্রেন টিউমারের একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ।
স্মৃতিভ্রংশ
মস্তিষ্কের সম্মুখভাগ বা ফ্রন্টাল লোব নামক অংশ চিন্তাপ্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। সুতরাং, মস্তিষ্কের এই অংশে টিউমার জন্মালে তা থেকে নিম্নলিখিত উপসর্গগুলি দেখা দিতো পারে:
- সহজেই বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। এই অবস্থাত সূচনা রোজকার সাধারণ কাজকর্মের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়। যেমন ধরুন, দিকনির্নয় করতে অক্ষমতা, বা সময়ের সাথে সাথে লোকের নাম ভুলে যাওয়া ইত্যাদি।
- মনঃসংযোগ করতে অসুবিধা হওয়া
- একইসাথে একাধিক কাজ করবার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া বা ব্যাহত হওয়া
- ব্রেন টিউমারের ফলে আপনার তীব্র স্মৃতিবিভ্রম বা স্মৃতি লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তাৎক্ষণিক স্মৃতিভ্রংশ (শর্ট টার্ম মেমরি লস) এই রোগের একটি প্রধান লক্ষণ
মুড ডিজঅর্ডার বা অকারণে মেজাজ বিগড়ে যাওয়া
হঠাৎ করে মেজাজ পরিবর্তন হওয়া বা মুড সুইং নামক অসুবিধার সাথে আমরা সকলেই কম বেশি পরিচিত। কিন্তু মুড সুইং আর মুড ডিজঅর্ডার দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। মুড সুইংএর ক্ষেত্রে আপনি হঠাৎ মেজাজের পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন। অন্যদিকে, মুড ডিজঅর্ডারের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী এবং তা সময়ের সাথে সাথে ক্রমশ গুরুতর হতে থাকে। এই পরিবর্তন আপনাকে এমনকি নিজের ক্ষতি করার দিকেও চালিত করতে পারে। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি ইত্যাদি হলো কিছু সাধারণ মুড ডিজঅর্ডারের উদাহরণ। এর পরিচিত রূপ গুলি হলো:
- সামাজিক পরিস্থিতি বা একাধিক ব্যক্তির উপস্থিতিতে অ্যাংজাইটি দেখা দেওয়া
- অনিদ্রা
- নিজের প্রিয় বিষয়গুলির প্রতি অনীহা দেখা দেওয়া
- নিজেকে নগণ্য বা মূল্যহীন মনে হওয়া
ব্রেন টিউমারের বৈজ্ঞানিক উপসর্গ
দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া
কথা বলা, পড়া ও হাতের লেখার ধরণে পরিবর্তন
ওপরে তাকাতে অসুবিধা
ভারসাম্য নষ্ট হওয়া
নারীদের ক্ষেত্রে স্তন্য উৎপাদনে সমস্যা
মুখের অসাড়তা
মস্তিষ্কের কাণ্ডে বা স্টেম অংশে টিউমার হলে সমস্ত মুখ বা মুখের একাংশে অসাড়তা, এমনকি মুখে সম্পূর্ন বা আংশিক পক্ষাঘাত পর্যন্ত দেখা দিতে পারে।